সিঙ্গাপুরে বাড়ছে জেনোফোবিয়া
অনলাইন ডেস্ক
কভিড-১৯-এর প্রভাবে মন্দায় ভুগছে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি। এরই ধারাবাহিকতায় সেখানে বেকারত্ব ও কর্মী ছাঁটাইয়ের পরিমাণও বাড়ছে। নিজেদের এ দুর্ভোগের পেছনে সেখানে কর্মরত অভিবাসী, বিশেষ করে ভারতীয়দের দায়ী করছে সিঙ্গাপুরের স্থানীয় নাগরিকরা। সিঙ্গাপুরিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান এ জেনোফোবিয়ার (বিদেশী অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব ও আচরণ) মূল লক্ষ্য ভারতীয় অভিবাসীরা হলেও এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন সেখানে অবস্থানরত চার লাখ বাংলাদেশী শ্রমিকও।
জেনোফোবিয়া ও বর্ণবাদ সিঙ্গাপুরে নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেখানকার নাগরিকরা বরাবরই স্থানীয়দের মধ্যে বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য অভিবাসীদের দায়ী করে এসেছে। এক্ষেত্রে তাদের রাগ সবচেয়ে বেশি ভারতীয় অভিবাসীদের প্রতি। দেশটির ব্যাংকিং, ফাইন্যান্স ও আইটি খাতসহ হাইপ্রোফাইল ও উচ্চবেতনের চাকরির বড় একটি অংশ ভারতীয়দের দখলে। এছাড়া গণপরিবহন ও আবাসন খাত চাপে পড়ে যাওয়ার পেছনেও ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে অভিবাসী কর্মীদের দায়ী করে এসেছে স্থানীয়রা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ মুহূর্তে সিঙ্গাপুরিদের বেকারত্বের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে ২০০৫ সালে ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সিঙ্গাপুর সরকারের একটি চুক্তিকে। ইন্ডিয়া-সিঙ্গাপুর কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট (সিইসিএ) শীর্ষক ওই চুক্তিটি মূলত দুই দেশের মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চুক্তিটি নিয়ে বর্তমানে বেশ সমালোচনা হচ্ছে। সিঙ্গাপুরিদের দাবি, এ চুক্তির কারণেই কোনো ভারতীয় নাগরিক সিঙ্গাপুরের আইটি ও ফাইন্যান্স খাতে কাজ করতে চাইলেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এমপ্লয়মেন্ট পাস (ওয়ার্ক পারমিট) পেয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতটাই ঝড় তুলেছে, নয় মাসে দুবার সিঙ্গাপুরের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে বিবৃতি প্রকাশ করে বলতে হয়েছে, চুক্তিটির বিষয়বস্তু পুরোপুরিই মুক্ত বাণিজ্যকেন্দ্রিক। এর সঙ্গে সিঙ্গাপুরে ভারতীয়দের কর্মসংস্থানের কোনো যোগসূত্র নেই।
এর পরও সেখানকার কর্মসংস্থান খাতে ভারতীয় অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে নিয়মিতই ঝড় উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিশেষ করে এ-সংক্রান্ত ভুয়া ছবি ও ভিডিওর ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে বেশি। সম্প্রতি টুইটারে সিঙ্গাপুরিদের মধ্যে ভারতের ডিবিএস ব্যাংকের হায়দরাবাদের একটি শাখার আইটি বিভাগের ছবি ভাইরাল হয়। পোস্টে এটিকে চাঙ্গি সিঙ্গাপুরের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবস্থিত ডিবিএস ব্যাংকের আইটি শাখার ছবি দাবি করে বলা হয়, ‘এখান থেকে কোনো সিঙ্গাপুরি বা চীনা খুঁজে বের করুন।’ ছবিটি সামাজিক মাধ্যমগুলোতে এতটাই ঝড় তুলেছে, একপর্যায়ে ডিবিএস ব্যাংককে বিবৃতি দিয়ে জানাতে হয়, ‘ছবিটি আমাদের ভারতীয় অফিসের, সিঙ্গাপুরের নয়।’
একইভাবে জুলাইয়ে চাঙ্গি বিচ পার্কে সময় কাটানো কয়েকজন ভারতীয়র ছবি এসজি অপোজিশন নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে শেয়ার করা হয়। ছবির ক্যাপশন দেয়া হয় ‘চেন্নাই পার্ক’। পোস্টটিতে সিঙ্গাপুর সরকারকে অভিযুক্ত করে বলা হয়, ক্ষমতাসীন পিপলস অ্যাকশন পার্টির ভোট বাড়াতেই ভারতীয়দের ক্রমবর্ধমান হারে সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে।
সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের অনেকেই এখন ২০১৩ সালের লিটল ইন্ডিয়া দাঙ্গার কথা স্মরণ করছে। বাসচাপায় এক ভারতীয় শ্রমিক নিহত হওয়ার জেরে ওই সময়ে ২ ঘণ্টা ধরে রাস্তায় চলাচলরত বাস, অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবাদানে ব্যবহূত অনেকগুলো যানবাহনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ঘটনায় ৬২ জন আহত হয়। ওই ঘটনায় ৩৩ জনকে অভিযুক্ত করে গ্রেফতার করা হয়, যাদের সবাই ভারতীয়। এছাড়া দুজন বাংলাদেশীকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে দাঙ্গার সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় ওই দুই বাংলাদেশীকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। সিঙ্গাপুরের ইতিহাসে ১৯৬৯ সালের পর এটিই ছিল প্রথম কোনো দাঙ্গার ঘটনা।
প্রবাসী বাংলাদেশীরা বলছেন, সিঙ্গাপুরের স্থানীয় নাগরিকদের বিরূপ মনোভাব মূলত ভারতীয়দের প্রতিই। বাংলাদেশীদের সঙ্গে বরাবরই ভালো আচরণ করে এসেছে তারা। সিঙ্গাপুরের ক্যাপেল শিপইয়ার্ডে ১০ বছর ধরে কর্মরত রয়েছেন ওমর ফারুক শিপন নামে এক বাংলাদেশী শ্রমিক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সব সিঙ্গাপুরি নাগরিক এক নয়। আমার সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, তাদের বাংলাদেশীদের প্রতি কোনো বিরূপ মনোভাব নেই। বিপদে-আপদে তারা আমাদের উৎসাহ-ভরসাও দেয়। আমাদের যারা সিঙ্গাপুরি সহকর্মী আছেন, তারা অনেক সময় জানতে চান, আমাদের কোনো সহায়তার প্রয়োজন আছে কিনা। মহামারীর কারণে আমরা এখন ডরমিটরিতে এক প্রকার বন্দি। আমরা যাতে বাইরে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারি, সেটি নিয়েও অনেক দেনদরবার করছেন তারা। যদি ডাক্তারের কাছে যেতে হয় বা অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে, দেখা গেল; কোনো সিঙ্গাপুরি তার গাড়ি নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে। আমার জানা মতে, বাংলাদেশীদের প্রতি কারোরই কোনো বিরূপ মনোভাব নেই, বরং তা ইতিবাচক।
একই কথা বললেন সিঙ্গাপুর প্রবাসী রাশিদুল ইসলাম জুয়েলও। সাত বছর ধরে সেখানকার জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশীদের কাজের মান ও দক্ষতা অনেক ভালো। তাদের প্রতি সিঙ্গাপুরি নাগরিক ও সহকর্মীদের মনোভাব অনেক ভালো। কিন্তু ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যে শৃঙ্খলা থাকলেও তারা তেমন একটা দক্ষ নয়। ফলে তাদের প্রতি স্থানীয়দের এক ধরনের বিরক্তি কাজ করে। এছাড়া লিটল ইন্ডিয়ার দাঙ্গার পর থেকেই ভারতীয়দের প্রতি স্থানীয়দের বিরূপ মনোভাবের মাত্রা বেড়ে চলেছে।
তবে বর্তমানে সিঙ্গাপুরিদের মধ্যে জেনোফোবিয়া বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের নিয়ম অনুযায়ী এখানে স্থানীয় নাগরিকদের নিয়োগ দেয়া হলে সর্বনিম্ন যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়, সে পরিমাণ অর্থে তিনজন বিদেশী কর্মী নিয়োগ দেয়া যায়। এ কারণে বর্তমানে মহামারী পরিস্থিতিতে সিঙ্গাপুরি কোম্পানিগুলো স্থানীয়দেরই ছাঁটাই করছে বেশি। নিয়ম অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় কর্মীদের কোটা পূরণ করতে যতজন প্রয়োজন, শুধু সে কয়জনকেই রাখা হচ্ছে। বাকি জনবল পূরণ হচ্ছে বিদেশীদের দিয়ে। আবার স্থানীয় যারা থাকছেন, তারা ওভারটাইম বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না। এছাড়া তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় কোম্পানি সেটা পরিশোধ করতে চায় না। কিন্তু বিদেশীদের ডরমিটরিতে থাকা-খাওয়ার খরচও দেয়া হচ্ছে। যদিও সেটা তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় কিছুই নয়, কিন্তু সেটিও তাদের অসন্তোষের কারণ হয়ে উঠেছে।
সিঙ্গাপুরিদের মধ্যে বাংলাদেশীদের প্রতি আলাদা করে এখন পর্যন্ত বিরূপ কোনো মনোভাব দেখা না গেলেও সেখানকার শ্রমবাজারের ভবিষ্যৎ একেবারে ঝুঁকিমুক্ত নয়। সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউর প্রতিশ্রুতি ছিল, ১৯৯১ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরের শ্রমবাজার হবে শতভাগ স্থানীয়নির্ভর। তিনি বলেছিলেন, অভিবাসী শ্রমিকনির্ভরতার কারণে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও পশ্চিম জার্মানি যে ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তা সিঙ্গাপুরের ক্ষেত্রে কাম্য নয়।
বর্তমানে দেশটির রাজনীতিবিদদের বড় একটি অংশ এখন বিদেশী শ্রমিকনির্ভর শ্রমবাজারের বিপক্ষে কথা বলছেন। ‘ফর এ বেটার সিঙ্গাপুর’ শীর্ষক ব্লগে সিঙ্গাপুরের রাজনীতিবিদ ও সংসদ সদস্য ই জেন জং সম্প্রতি অভিযোগ তোলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সিঙ্গাপুর সরকার। কভিড-১৯-এর ব্যাপক প্রাদুর্ভাব নগররাষ্ট্রটির সস্তা অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি অতিনির্ভরতাকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, কম মজুরিতে কাজ করা বিদেশী শ্রমিকদের উপস্থিতিতে কম দক্ষ সিঙ্গাপুরি শ্রমিকদের মজুরিও চাপে রয়েছে। এর ফলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির প্রকৃত সুবিধাভোগীদের সঙ্গে দুই দশক ধরে যাদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির হার শ্লথ হয়ে রয়েছে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমেছে, তাদের মধ্যে এক ধরনের বিভেদ তৈরি হয়েছে।
তবে সিঙ্গাপুরিদের বর্তমান জেনোফোবিয়ার পেছনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকেই দায়ী করছেন সিঙ্গাপুরভিত্তিক নানইয়াং টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লাবন্য কাথিরাভেলু। আন্তর্জাতিক কূটনীতিবিষয়ক ইংরেজি গণমাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাটকে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে জেনোফোবিয়ার মতো বিভেদমূলক আচরণের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যায়। এ সময় মানুষের মধ্যে পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট কাঠামোগত ইস্যুগুলোকে অনুধাবনের প্রয়াস চালানোর বদলে দায়ী করার মতো সহজ লক্ষ্য খোঁজার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।